একটি মুরগিতত্ত্ব

অনলাইনে বা অফলাইনে যারা নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে অথচ মুরগিতত্ত্ব শোনেননি এরকম লোক পাওয়া যাবেনা। ” শিয়ালে তো মুরগির স্বাধীনতা চাইবেই, তাতে তো শিয়ালেরই লাভ “ কথাটা বলার পরে সেই ব্যক্তি একটা তৃপ্তির ঢেকুর তোলে। আচ্ছা একখান বাঁশ দেওয়া হয়েছে ভাবে! কি চিন্তাধারা রে বাবা ! নারীকে মানুষ ভাবতে তাদের গায়ে লাগে, নিজেকে একজন নারীর ‘মালিক‘ ভেবে আনন্দ পায়। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের মালিক !

একটি মুরগিতত্ত্ব

শিয়াল vs মুরগি

এই ফালতু মুরগি শিয়াল তত্ত্ব নিয়ে লেখা প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না, কিন্তু যখন প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্র এটাকে জবাব বলে মনে করে তখন লিখতেই হবে। ধরে নিলাম, নারীবাদীরা শিয়াল আর নারীসমাজ মুরগির দল। সেই হিসাবে যারা একথা বলেন তারা মুরগির মালিক অর্থাৎ গৃহস্থের ভূমিকা পালন করেন । গৃহস্থ মুরগির নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে থাকেন, মুরগিকে খাঁচায় রাখেন। খুবই ভাল কথা। কিন্তু গৃহস্থ এতকিছু করে কার স্বার্থে ? মুরগির নাকি নিজের ?
বছরে কয়টা মুরগি গৃহস্থ নিজের পেটে চালান দেয় আর কয়টা শিয়ালের পেটে যায় ? আমাদের তো গত দশবছরে তিনটে মুরগি শিয়ালে খেয়েছে আর আমরা কয়টা খেয়েছি তার তো হিসাবই নাই ! যদি আবার ব্রয়লার পোষা হত তাহলে তো শিয়ালে মুরগি চোখেও দেখতে পেত না! দেশি মুরগি আবার ব্রয়লার থেকে একটু বেশি স্বাধীন, নিজের ইচ্ছামত চারদিকে চরতে পারে। ব্রয়লার জাতীয় মুরগি সেইহিসাবে খুব পর্দানশীন :p ।

কিন্তু প্রশ্ন হল, মুরগি গুলো এত পর্দানশীন হওয়ার পরে বাঁচে সর্বোচ্চ ৫০ দিন, কেননা তাদের পোষাই হয় জবাই করার জন্য। শিয়াল নাহয় অতি খারাপ প্রাণী কিন্তু গৃহস্থ তো তার চাইতে অধিক খারাপ! এত যত্নের সাথে পুষে রেখে তার থেকে বেশি যত্ন করে রান্না করে খায়। এত খাঁচা, এত ঘিরে রাখা কার স্বার্থে, মুরগির নাকি মুরগির মাংসের স্বাদে চোখ বুজে ফেলা গৃহস্থের? মুরগি তো সেই এক অবস্থানেই থেকে গেল। সে শিয়াল হতে বেচে গিয়ে গৃহস্থের পাকস্থলীর খোরাকে পরিণত হল। মুরগির ভাগ্যের কোন পরিবর্তন তাতে হয় না।

এইসব মুরগি তত্ত্বওয়ালা ভাইদের বলতে চাই, আপনারা যতই গলা ফাটান না কেন যে আপনাদের ধর্মই নারীকে দিয়েছে সর্বোচ্চ সম্মান (!); আপনাদের মানসিকতা গত ১৪০০ বছরে খুব একটা পাল্টায়নি। আগে শস্যক্ষেত্র ভেবে চাষাবাদ চালাতেন ,এখন মুরগি ভেবে পোষেন, বা মিষ্টি মনে করে মাছি হিসাবে গিয়ে বসেন। নারীকে কখনই আপনারা মানুষ হিসাবে ভাবতে পারেননা, গরুছাগল এর ন্যায় পুরুষের চাহিদা মেটানো ‘নারী’ নামক আরেক প্রজাতির প্রাণী মাত্র। আপনি নারীর মালিক নন যে সে কি করবে সেটা আপনি নির্ধারণ করবেন ।

অন্যদের ঠিক করার আগে নিজের মানসিকতা পাল্টান, দেখবেন সব পাল্টে গেছে।

(সেই কিউত ভাইয়াটাকে বলছি, আপনি জীবনে অনেক ডাক্তার -ইঞ্জিনিয়ার হইতে পারবেন হয়ত,কিন্তু এইরকম চিন্তাধারা নিয়ে আর যাই হোন না কেন মানুষ হিসাবে নিজেকে দাবী কইরেন না যেন। তাহলে মানুষ নামক প্রাণীরা লজ্জা পাবে।)

আদিবাসীদের নিয়ে কিছু প্রশ্ন এবং আমার উত্তর ও কিছু ভাবনা

আজকে স্বপ্নহারা পথিক ভাই আমাকে ইনবক্সে কিছু প্রশ্ন করেছেন। পাহাড়ীদের নিয়ে আজ অনেক পোস্ট এসেছে,মনে হয় না খুব বেশি কিছু বাকি আছে বলার জন্য। তবুও আমি আমার ধারণাটুকু জানাচ্ছি।

আপনার পাঠানো স্ক্রিনশট থেকে আজকের দিবস উপলক্ষে একজন চাকমার পোস্ট দেখলাম। সেখানে যা লেখা আছে তা আমার জন্য অস্বস্তিকর ও অপমানজনক।

আজ কুকুরের বাচ্চা দিবস। আজকের দিনে কুকুরদের বাবা জন্মগ্রহণ করেছিল। কুকুরগুলোর আজ বিশেষ দিন তাই সরকারী বন্ধ। যাদের যাদের কুকুর আছে আজকে একটু বেশি করে ভাত দাও।

এরপরেও কেন আমরা আদিবাসীদের পক্ষে দাড়াবো ? এটা হল প্রশ্ন। আমার বন্ধুতালিকায় এরকম একজন ছিল যাকে অনেক আগে আনফ্রেন্ড করেছি এধরনের কথা বলার জন্য। কিন্তু আমি প্রতিবাদ করতে পারিনি । কারণ, আমার প্রতিবাদ করার মত ভিত্তি আমার স্বজাতি রাখেনি। আমি চোরের মত খালি আনফ্রেন্ডই করেছি, আমার অসহ্য লাগায়।
আদিবাসীদের একজন আমাদের কুকুরভাবে, এখন আপনার কাছে প্রশ্ন হল স্বাধীনতার পরে থেকে আমরা বাঙালি পরিচয় দানকারীরা কতটুকু তাদের সাথে ভাল আচরণ করেছি যে, আমাদের কে এর চাইতে ভাল ভাববে? আমরা তাদের বসতভিটা কেড়ে নিয়েছি, তাদের জাতিগত পরিচয় কেড়ে নিয়ে তাদের বাঙালি হয়ে যেতে নির্দেশ দিয়েছি, তাদের নারীদের ধর্ষণ করে চলেছি গনিমতের মাল ভেবে। আমাদের টাকায় কেনা বুলেটে রক্ত ঝরে আদিবাসীদের। আমরা কি তাদের মানুষ ভাবি? এদেশের নাগরিক ভাবি?
পাকিস্তানিরা আমাদের সাথে যে আচরণ করেছিল,আমরা সেই একই আচরণ করে চলেছি। আমরা কি পাকিস্তানিদের ঘৃণা করিনা এখনও ? পাকিস্তানিদের আচরণের জন্য আমরা এখনো জাতি হিসাবে গালি দিই তাদেরকে। আমরা আমাদের জাতির পিতা হিসাবে মানি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

সন্তান হিসাবে যখন আমরা কোন খারাপ কাজ করি তখন আমাদের সাথে সাথে আমাদের পিতাও গালি খায়। পিতাকে গালি দিলে পুত্র হিসাবে রাগ হওয়ারই কথা, কিন্তু পিতার মর্যাদা রক্ষা করতে কি সামান্যতম সচেতন আমরা? আমরা অন্যদের উপর অত্যাচার করেই চলবো আর তারা আমাদের গালি দেবে না এমনটা কি করে ভাবি?

এরপরে বলেছেন, তারা আসলে নিজস্ব সংস্কৃতি চায় না,তারা চায় নিজস্ব শাসন ক্ষমতা।
এবার আসি কেন তারা নিজস্ব শাসন ক্ষমতা চাচ্ছে সেই প্রসঙ্গে।

পৃথিবীর অধিকাংশ স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমিই কিন্তু এই সাংস্কৃতিক অবদমন থেকে শুরু।

আমাদের স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রামও শুরু হয়েছিল এই সাংস্কৃতিক অবদমন থেকে। আমাদের রবীন্দ্র চর্চা বন্ধ করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল, আমাদের ঘাড়ে উর্দূ চাপিয়ে দিয়ে আমাদের মূল পরিচয় বাঙালি সেটাই লোপ করার চেষ্টা করা হয়েছিল। একসময় আমরা আর পাকিস্তানিরা আসলে এক নই ‘আলাদা‘। কিন্তু যদি আমাদেরকে আমাদের মত চলতে দেওয়া হত তাহলে এই ‘আলাদা‘ মনোভাবটা সৃষ্টি হত না, আমরা সেটাকে বৈচিত্র হিসাবেই ভাবতাম। আর এই ‘আলাদা‘ ভাবার অনুভুতিটা শুরু হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত ধরেই। রাষ্ট্রযন্ত্রই বোনা শুরু করে নানা ‘আলাদা‘ ভাবার বীজসমূহ, আর তা একসময় মহীরুহ হয়ে ওঠে। আমাদের সরকারী সার্কুলার সমুহে লেখা থাকে “পার্বত্য তিন জেলা ব্যতীত“, যেন পার্বত্য তিন জেলা বাংলাদেশের মধ্যে নয়! আমরা আলাদা ভাবাতে শিখিয়েছি তাদেরকে তাই তারা আজ জুম্মল্যান্ডের মানচিত্র প্রকাশ করে। শাসক যখন শোষক এর ন্যায় আচরণ করে তখনই আসে স্বাধিকারের দাবি। রাষ্ট্র যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রতিনিধিত্ব করে, সংখ্যাগরিষ্ঠদের পক্ষে কাজ করে (আসলেই কি?) , তাই বিরোধটাও সৃষ্টি হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে বাঙালিদের সাথে।

এরপরে আপনার পরিবারের সাথে ঘটা একটা দুঃখজনক ঘটনা কথা বলেছেন। আপনার বাবাকে UPDF সংগঠনটি অপহরণ করেছিল,৮ লাখ টাকা মুক্তিপণের মাধ্যমে ১৬ দিন পর ছাড়িয়ে আনেন। এইজাতীয় সংগঠনগুলো নিয়ে আমার একটাই মতামত, দীর্ঘদিন ধরে চলা যেকোন অধিকার আদায়ের আন্দোলন এ দেখা যায় কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে। আর এই সুবিধাভোগী গোষ্ঠীগুলোই আন্দোলনকে বেহাত করার চেষ্টা করে, কলঙ্কিত করে। সাধারণ জনতা সে যে পক্ষেরই হোক না কেন এর কুফল ভোগ করে। পাহাড়িদের সংগঠনগুলো এখনো নিজেদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যে রেষারেষি, লড়াইয়ে আবদ্ধ তার ফলে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে আদিবাসীরাই।

লেখাটা বেশি বড় হয়ে গেল,পড়ার মত ধৈর্য থাকবে না হয়ত কারো। তবুও কিছু উদাহরণ দেওয়াটা প্রয়োজন বলে মনে করছি —
*সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ৭টি,
*হত্যাকান্ডের শিকার ৮ জন,
*শারীরিক নির্যাতনের শিকার ১২৬ জন এবং ১২২ জন শিশু ও নারী সহিংসতার শিকার হয়েছে।
এছাড়া গত বছর ভুমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে ৩ হাজার ৯১১ একর। ১০২টি পরিবার উচ্ছেদের শিকার হয়েছে। হুমকিতে আছে আরো ৮০০ পরিবার। আর দেশ ছেড়ে গেছে প্রায় ৮০০ মানুষ।
আর গৃহবধু ধর্ষণ কান্ডের রেশ পেরোতে না পেরোতেই বিশ্বকাপের জয় উদাযাপন করা হল ছাত্রী ধর্ষণের মাধ্যমে ।তার প্রতিবাদে হওয়া মিছিলে হামলা হলো, আর ১৫ তারিখে বসতি উচ্ছেদ করে বিজিবির ব্যাটালিয়ন সদরদপ্তর স্থাপনের প্রতিবাদে হওয়া মিছিলে সেনাবাহিনী তো গুলি করেই বসলো।
অত্যাচারিতের পক্ষে কথা বলাটাই তাই শ্রেয় ভাবি,সে যেই হোক না কেন।